একশ কোটি টাকার গাছ আওয়ামী লীগের পেটে
লিখেছেন লিখেছেন এফ শাহজাহান ২৪ জুলাই, ২০১৩, ০৮:০৪:৫০ রাত
ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে পরিকল্পিতভাবে কোটি কোটি টাকার সরকারী গাছ লুটপাটে মেতে উঠেছে আওয়ামী লীগ। গত কয়েকদিনে বগুড়ার ধুনট,শাজাহানপুর এবং শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে একশ কোটি টাকার গাছ কেটে সাবাড় করেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা। আওয়ামী লীগের এমপি থেকে শুরু করে স্থানীয় যুবলীগ ছাত্রলীগের নেতারাও এই গাছ লুটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। দলীয় নেতা কর্মীদের এভাবে সরকারী গাছ লুটের পেছনে স্থানীয় এমপি এবং বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিরোধী দলের হরতাল অবরোধ চলাকালে সড়কে দু’একটি গাছ কাটার অভিযোগ নিয়ে সংসদে এবং রাজনৈতিক ময়দানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলীয় নেতাদের কঠোর সমালোচনা এবং গাছ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা বলার পর থেকেই শাসক দলের লোকজনদের কোটি কোটি টাকার এই বৃক্ষনিধনে নেমে পড়া নিয়ে এলাকায় আতংক শুরু হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারাও অসহায় হয়ে পড়েছেন।
বনবিভাগের সামাজিক বনায়নের আওতায় ২০ বছর আগে সরকারী রাস্তার দুইপাশে লাগানো হাজার হাজার গাছ এখন বেশ পরিপক্কও হয়েছে। এসব মুল্যবান গাছের একটি অংশের অংশীার স্থানীয় পাহারাদার বা উপকারভোগী। দুবৃত্তরা এভাবে গাছগুলো হরিলুট করায় সরকার যেমন কোটি কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি এসব দরিদ্র উপকারভোগীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন।
বগুড়ার ধনুটে বন বিভাগের অনুমতি ছাড়াই বগুড়ার ধুনট সমন্বিত উন্নয়ন সংস্থা (ডিআইডিপির) রাস্তায় লাগানো সামাজিক বনায়নের প্রায় ৫০ কোটি টাকার গাছ অবৈধ কেটে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। শেরপুরে বনবিভাগের লাগানো সরকারী রাস্তার ২০ কিলোমিটার জুড়ে ২০ বছর বয়সী প্রায় ২ কোটি টাকার গাছ কেটে নিয়েছেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। একই ভাবে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় রাতের আঁধারে আরো কয়েক কোটি টাকার সরকারী গাছ কেটে সাবাড় করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উইলিয়াম দাতা সংস্থা পিইপির ব্যানারে ধুনটের এসব গাছ লুট করা হয়েছে। আর এই গাছ কাটতে ব্যবহার করা হয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিকলীগের তিন বির্তকিত নেতাকে। এব্যাপারে ডিআইডিপি আদালতে ৭টি মামলা করেছে পিইপির বিরুদ্ধে।
স্থানীয়রা জানান,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক উইলিয়াম খ্রিষ্টেনসেন ১৯৮৭ সালে ধুনট উপজেলার মাটিকোড়া এলাকায় ‘ধুনট সমন্বিত উন্নয়ন ডিআইডিপি নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। ডিআইডিপি ধুনট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের মানুষদের স্বাবলম্বী ও পুনবাসন কর্মসূচী হাতে নেয়। ওই সংস্থা বিনামুল্যে স্যনিটেশন, মৎস্য চাষ, কুঠির শিল্প, রেশম চাষ,গবাদী পশু বিতরনের মাধ্যমে নানা কর্মসুচি চালুর পাশাপাশী ২০শতাংশ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, ৬০ শতাংশ সংস্থার তালিকা ভুক্ত গরীব মানূষ, বাকী ২০ শতাংশ সংস্থা পাবে সরকারে সাথে এমন চুক্তি করে ২৮ আগে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন সরকারী রাস্তার দু ’পাশে মেহগনি,রেইট্রি,আকাশমনি সহ বিভিন্ন কাঠ জাতীয় গাছ লাগিয়ে বনায়ন কর্মসুচীও চালু করে। সংস্থার তালিকা ভুক্ত দুস্থ মহিলাদের দ্বারা রাস্তায় লাগানো বনায়নের ওইসব গাছ পরিচর্যা ও রানবেন করানো হয়। দির্ঘ দিনে রাস্তায় লাগানো ওই সব গাছ কোটি কোটি টাকা মুল্যের সম্পদে পরিণত হয়।
ডিআইডির ধুনট উপজেলার ১১৫ কিলোমিটার রাস্তার দুপার্শে ১৬ হাজার গাছ রোপন করে। নিয়ম মেনে ২০১২ সালের অক্টোবরের কিছু গাছ বিক্রির টেন্ডার আহবান করে ডিআইডিপি। এনিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হলে ঐ মুল্যবান গাছগুলো কেটে সাবাড় করে শাসক দলের প্রভাবশালীরা। এসব গাছের আনুমানিক মুল্য ৫০ কোটি টাকা।
দেখা গেছে, গাছ কাটার সময় ধনুট উপজেলার ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ,যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক মামা-ভাগ্নে গ্রুপের বির্তকিত নেতা ও একাধিক মামলার আসামী তাদের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে গাছ কাটতে সহযোগিতা করেছে। ওই গাছ কাটার ৩০ লাখ টাকার ভাগাভাগি নিয়ে যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের সাথে হামলা,পাল্টা হামলা কার,মটর সাইকেল ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
এবিষয়ে বগুড়া ৫ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আলহাজ হাবিবর রহমান জানান,তার লোকজন গাছ কেটেছে এমন অভিযোগ সত্য নয়। তবে গাছ বিক্রির টাকা সুবিধাভোগী ও ইউনিয়ন পরিষদকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আব্দুল খালেককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দরিদ্র নিরসন কর্মসূচীর পিইপির জেলা মাঠ সমন্বয়কারী আব্দুল খালেক বলেন, ডিআইডিপির সামাজিক বনায়নের গাছ তৎকালীন বগুড়ার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পিইপির নামে লিখে নেওয়া হয়েছে। এর পর টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে।
চৌকিবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খুদরত ই খুদা জুয়েল, মথুরাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ফিরোজ, গোপাল নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম ও এলাঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ তারেক হেলাল বলেন, ডিআইডিপির রাস্তায় সামাজিক বনায়নের প্রায় ৫০ কোটি টাকার গাছ অবৈধ ভাবে বিক্রি করেছে পিইপি সংস্থা। টেন্ডার কমিটিতে তাদের সদস্য রাখা তো দুরের কথা চুক্তি অনুযায়ী গাছ বিক্রির ২০ ভাগ টাকা ইউনিয়ন পরিষদকে দেওয়া হয়নি। ভুক্তভোগী চেয়ারম্যানগন এর প্রতিকার না পেলে আদালতে মমলা করবেন বলে জানিয়েছেন।
সুবিধাভোগী ছোলায়মান , আব্দুল মজিদ ,লাইলী, খুশিতন ও সন্দেশ আলী আঞ্চািলক ভাষায় বলেন, ২৮ বছর ‘থাইকা খ্যায়া না খ্যায়া গাছ গুলো দ্যখা হুইনা আকছি ও যতœ করছি ভবিষতের আশায়’। হুনছি এমপি সাবের সাথে যোগাযোগ করে আমাগেরে গাছ গুলো অবৈধ ভাবে বিক্রি করে দিল। কিন্ত আমাগেরে একটা ট্যাহাও দিল না।
বগুড়ার শেরপুরের বিভিন্ন সড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে লাগানো বনবিভাগের দুই কোটি টাকার গাছ কেটে সাবাড় করেছে দুবৃত্তরা। উপজেলা বন অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের উদাসিনতায় ২০ বছরের পুরনো ৪ শতাধিক মুল্যবান সরকারী গাছ গুলো বন দস্য্যুরা রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন উপজেলার সীমাবাড়ী থেকে রানীরহাট পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এবং ভবানীপুর বাজার থেকে ভাদড়া পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তার সরকারী গাছ গত কয়েকদিন ধরে রাতের বেলা কেটে ট্রাকভর্তি করে অভিনব কায়দায় এলাকার বন দস্যুরা নিয়ে গেছে ।
রাস্তার গাছ পাহারায় নিযুক্ত ভবানীপুরের শামসুল ইসলাম ভাটু জানান, উপজেলার সীমাবাড়ী থেকে রানীরহাট পর্যন্ত ১৯৯০ সালে ১৫ কিলোমিটার রাস্তায় প্রায় ১০ হাজার ইউকেলিপটাস, শিশু ও রেইনট্রি গাছ শেরপুর বন বিভাগ লাগিয়েছিল। এ রাস্তার গাছ পাহারা দেবার জন্য উপকার ভোগী ও এক জন সভাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল । এই ছোট গাছ গুলো এখন অনেক বযস হয়ে গাছ গুলো শুকিয়ে খড়ি হয়ে যাচ্ছে। যা বন বিভাগে টেন্ডার দিয়ে পুরোনো গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও উপজেলার বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোন পদপে নেয়নি। যার ফলে কোটি কোটি টাকার সরকারী গাছ এখন বন দস্যুদের ছোবলে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
আরেক পাহারাদার ঢেপুয়া গ্রামের বুদা মন্ডল জানান, অনেক বার গাছ চোর হাতে নাতে ধরে বন বিভাগ কর্মকর্তাদেরকে জানিয়ে ছিলাম। তারা এসে গাছ নিয়ে গেলেও অপরাধীরা কোন শাস্তি পায়নি।
সুবিধাভোগীদের সভাপতি শরিফুল জানান বন দস্যুরা প্রথমে রাস্তার উপকার ভোগী ও সভাপতির সাথে গোপনে আতাত করে এবং বন বিভাগ কর্মকর্তাদের সাথে সখ্যতা রেখে এপর্যন্ত প্রায় ৪ শতাধিক সরকারী গাছ কেটেছে। যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি টাকা। আর এর সাথে জড়িত আছেন চান্দাইকোনার এক ছ মিল মালিক। ভবানীপুর ইউনিয়র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম তার সঙ্গে আতাত করে রাতা রাতি চুরি করা গাছ কেটে চান্দাইকোনা কাঠ ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন । তবে অভিযুক্ত শফিকুলের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়রা জানান,বুধবারে ভবানীপুরের পশ্চিম পাশে এক ছ,মিলে চুরি করা কাঠ পাওয়া যায়, খবর পেয়ে শেরপুর বন বিভাগের কর্মকর্তা মাহবুবুর রশিদ দ্বিতীয় বারের মত আবারওসেগুলো জব্দ করে অফিসে নিয়ে যান । এনিয়ে গত দু‘সপ্তাহে স্থানীয় জনতার হাতে দুইবার গাছ চোর হাতে নাতে ধরা পড়লেও এ পর্যন্ত কোন গাছ চোরের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থানেয়নি বন বিভাগ।
এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাহবুবুর রশিদ জানান, আমাদের করার কিছু নেই। বগুড়া জেলা বন বিভাগ যতন পর্যন্ত আমাদের কোন অনুমতি না দিবে ততন পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারবোনা ।
এব্যপারে শেরপুর থানার ওসি আমিরুল ইসলামের জানান, বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করে দেখছি। দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বগুড়ার শাজাহানপুরেও সরকারী রাস্তার গাছ চুরির হিড়িক পড়েছে। বেশ কিছুদিন এই এলাকায় কয়েক কোটি টাকার সরকারী গাছ কেটে সাবাড় করা হয়েছে। উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের নয়মাইল-নগরহাট সড়কের এলজিইডি’র প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তার শত শত গাছ রাতের আধারে কেটে নিয়েছে দূর্বৃত্তরা।
মঙ্গলবার গভীর রাতেও ওই রাস্তার মাড়িয়া গ্রাম এলাকায় বেশ কয়েকটি গাছ কেটেছে দূর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে সকালে থানা পুলিশ ডেমাজানী এলাকায় অবস্থিত দুইভাই ছ’মিল নামের একটি করাত কল থেকে গাছের বেশ কিছু গুল উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।
স্থানীয়রা জানায়, স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের ইন্ধনে মাড়িয়া গ্রামের রতন, হালিম সহ বেশ কয়েকজন যুবক রাতের আধারে দীর্ঘদিন ধরে গাছ চুরি করে আসছে। গাছ চুরির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও দূর্বৃত্তদের ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না।
্এবিষয়ে শাজাহানপুর থানার ওস মাহমুদুল আলম জানান, গাছ চুরির সাথে কারা জড়িত সে বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি তবে চুরিকরা বেশ কিছু গাছ উদ্ধার করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে শাজাহানপুর,শেরপুর এবং ধুনট উপজেলা বন কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি রাতের আঁধারে রাস্তার গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্তরা। আমরা বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।
শেরপুর ও ধুনটের বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাহবুবুর রশিদ ও
বগুড়া বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার মাহবুবুল আলম বলেন, রাস্তায় সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে বিক্রির সঙ্গে শক্তিশালী একটি চক্র জড়িত রয়েছে । এদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে রাজতৈনিক হস্তক্ষেপে এসব গাছ বিক্রির বিষয়টি অবগত হওয়ার পর তিনি বিষয়টি নিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ব্যাবস্থা নেবেন বলে জানান।
বিষয়: বিবিধ
১৮৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন